দুর্নীতি সকল উন্নয়নের অন্তরায় কারণ দুর্নীতির ফলেই হতে পারে অর্থনৈতিকভঙ্গুরতা,ব্যক্তিগত,সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষতিসহ নানাবিধ সমস্যা।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মত স্থানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তা আরও প্রকটরুপ ধারন করেছে।অনেক আশা নিয়ে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন উচ্চশিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে। তবে তাতে ভাটা পড়ে যখন দেখা যায় সেসব শিক্ষার্থীর উচ্চ শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে এই দুর্নীতিই।
দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি অর্থের ‘হরিলুট’ চলছে এমন শিরোনামে পত্রিকায় খবর ও প্রকাশিত হয়।ব্যক্তিগত ড্রাইভারকে পঞ্চম গ্রেড বা উপসচিবের সমান বেতন প্রদান, বয়স পার করার পরও ‘সেশন বেনিফিটের’ মাধ্যমে চাকরিতে বহাল রাখা,বাংলোতে বসবাসের পরও উপাচার্যের বাড়ি ভাড়া নেয়াসহ এভাবে অন্তত ২০টি খাতের আড়ালে উপাচার্য থেকে শুরু করে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিধিবহির্ভূতভাবে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ইউজিসির সদস্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর গনমাধ্যমকে জানান, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সিন্ডিকেট বা রিজেন্ট বোর্ডে নিজেদের প্রয়োজনমতো নিয়ম পাশ করে নিতে পারে। এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে কিছু ক্ষেত্রে অবৈধ আর্থিক সুবিধা গ্রহণের নিয়ম পাশ করে নিয়েছেন কেউ কেউ। ইউজিসির হিসাব ও নিরীক্ষা বিভাগের দীর্ঘ অনুসন্ধান ও তদন্তে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ নিয়ে কমিশনের বৈঠকে সুনির্দিষ্ট আলোচনার পর সতর্ক করার লক্ষ্যে পরিপত্র জারির সিদ্ধান্ত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ২০ খাতে বিধিবহির্ভূত আর্থিক সুবিধা নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো হচ্ছে-উচ্চতর স্কেলে বেতন প্রদান; বিধিবহির্ভূতভাবে পঞ্চম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তাকে তৃতীয় গ্রেড প্রদান; ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি ও স্কেল প্রদান, যোগদানের তারিখ থেকে পদোন্নতি; অননুমোদিত পদে নিয়োগ, আপগ্রেডেশন ও বেতন প্রদান; অনর্জিত ইনক্রিমেন্ট প্রদান; বেতনের বাইরে নানান নামে উপাচার্য হিসেবে অতিরিক্ত অর্থগ্রহণ; বাংলোতে বসবাস সত্ত্বেও বাড়ি ভাড়া গ্রহণ; পূর্ণ বাড়ি দেওয়ার পরও কম নেওয়ার উদ্দেশ্যে বর্গফুটের হিসাবে ভাড়াগ্রহণ। এছাড়া আছে-মফস্বলের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-জনবলকে সিটি করপোরেশনের হিসাবে বাড়িভাড়া প্রদান; এর বাইরেও সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া প্রদান; সরকারি নিয়ম লঙ্ঘন করে সেশন বেনিফিট প্রদান; পিআরএলের পরিবর্তে এলপিআর প্রদান; বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল ভর্তুকি দেওয়া; গবেষণা-মোবাইল-টেলিফোন-ইন্টারনেট ভাতা প্রদান, নিয়মের বাইরে বইভাতা দেওয়া; ড্রাইভারদের নবম থেকে পঞ্চম গ্রেডে বেতন দেওয়া; চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে সরকারের আর্থিক নীতিমালা লঙ্ঘন এবং যৌথ বিমা বা কল্যাণ তহবিলে (অর্থ) স্থানান্তর।
জানা গেছে, ড্রাইভারদের ‘টেকনিক্যাল অফিসার’ দেখিয়ে উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার সমান বেতন-ভাতা দেওয়া হয় ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি, মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুয়েটে। ইসলামী, খুলনা, শেরেবাংলা কৃষি, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি, খুলনা কৃষি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটের উপাচার্যরা কেউ বিশেষ ভাতা, কেউ বা দায়িত্ব ভাতার নামে বেতনের অতিরিক্ত ২০ শতাংশ হারে অর্থ নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে ছয় ধরনের নাম দেখা যায়। বাংলো থাকার পরও বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে।
নিয়োগের দিন থেকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নয়ন বা উচ্চতর স্কেল নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে বুয়েট এবং রুয়েটে। সহকারী রেজিস্ট্রারের নবম গ্রেডে বেতন পাওয়ার কথা। কিন্তু নিচ্ছেন ৫ম বা ষষ্ঠ গ্রেডে। আর উপরেজিস্ট্রারের ৭ম গ্রেডে নেওয়ার কথা। নিচ্ছেন চতুর্থ ও পঞ্চম গ্রেডে। এই ঘটনা ঘটে চলেছে ঢাকা ও রাজশাহীসহ ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। নানান কারণ দেখিয়ে অনর্জিত ইনক্রিমেট হিসাবে সর্বোচ্চ ৬টি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষক-কর্মচারীদের পূর্ণ বাড়ি দেওয়ার পর বর্গফুটে কম ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে ঢাকা, বাকৃবি, জাহাঙ্গীরনগর, ইসলামী এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নতুন প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইউজিসির উল্লিখিত অনুসন্ধানে কেবল অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত অনিয়ম ও দুর্নীতি বেরিয়ে এসেছে। এর বাইরে নিয়োগ, নির্মাণ, সংস্কারসহ আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম আছে। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন আয় বাজেটে দেখানো হয় না। এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয় এবং টেন্ডার ছাড়া কেনাকাটা এবং পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুৎপাদনশীল ব্যয়ের বড় একটি খাত হচ্ছে ঢাকায় রেস্ট হাউজ বা লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন। উপাচার্যরা ঢাকার বাইরে না যাওয়ার লক্ষ্যে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে এগুলো স্থাপন করে থাকেন। আবার ঢাকায় অবস্থানের সুবিধার্থে শিক্ষক-জনবলের জন্য রেস্ট হাউজ রাখা হয়েছে। সবমিলে অনেকটা বেপরোয়াভাবেই শিক্ষক-কর্মচারীদের অবৈধ উপায়ে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির ক্ষেত্রে একশ্রেণির ভিসি প্রধান ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। তারা এতটাই বেপরোয়া যে, তাদের সরকার স্পর্শ করতে পারবে না এমন কথাও প্রকাশ্যে বলে থাকেন।
এবার আসি শিক্ষার মানদন্ডে।বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুলোর চিত্র খুব একটা সন্তোষজনক নয়।উন্নত বিশ্বের সাথে তুলনা করলে শুধু শিক্ষার মানদন্ডে তো নয়ই অন্যান্য প্রায় সকল ক্ষেত্রে ও পিছিয়ে আছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি।উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে মূলত তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে: পাবলিক (সরকারি মালিকানাধীন), বেসরকারি (বেসরকারি মালিকানাধীন) এবং আন্তর্জাতিক (আন্তর্জাতিক সংগঠন কর্তৃক পরিচালিত)।বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে বর্তমানে ৫৮ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। স্বায়ত্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত এই সকল বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা করা হয় বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৮টি।সরকারি বেসরকারি সবমিলিয়ে যা প্রায় দেড়শতাধিক।
শিক্ষা ও গবেষণায় অনিয়ম ঠেকাতে ব্যর্থ হলে দেশের অনিয়ম ও দুর্নীতি ঠেকানো সম্ভব নয়। তাই একাডেমিক অপরাধকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা সময়ের দাবি।বিশ্ববিদ্যালয়ের গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার না করার কারণে যুগপৎ ছাত্র এবং শিক্ষকদের ওপর একাডেমিক চাপ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না।বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার চাকুরী পেলে নির্ধারিত দায়িত্ব অবহেলা করেও শিক্ষক মহোদয়ের পক্ষে সে চাকুরী অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত টিকিয় রাখা সম্ভব হচ্ছে।সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় টিকে থাকার জন্য শিক্ষকদের ওপর কোন একাডেমিক চাপ থাকছে না এবং দায়সারা পরীক্ষার আগে ক্লাসে গুরুত্বপূর্ণ টপিক পড়িয়ে কোর্স সম্পন্ন করছেন অনেকেই।তাছাড়া শিক্ষকদের একঅংশের জাতীয় দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতা তো রয়েছেই। ফলে তারা রাজনৈতিক সভা সমাবেশে প্রায়শই অংশগ্রহণ করে থাকে যার দরুন একাডেমিক বিষয়ে তারা সময় কম দিয়ে থাকেন।এতে মানসম্মত পাঠদান খানিকটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।অপরদিকে পাশ্চাত্য বা ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোতে রয়েছে ভিন্ন চিত্র।এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেই রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতা, নেই কোন সক্রিয় রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন।ফলে সেখানকার পড়াশোনার মান দিনে দিনে আরও উন্নত হচ্ছে।তাছাড়া এসব দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যতটা না কঠিন শিক্ষকতায় টিকে থাকা তার চেয়েও কঠিনতর।কেননা,এসকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের অস্থায়ী নিয়োগ দেয়া হয় এবং পরবর্তীতে তাদের পাঠদান ও গবেষণার মানের ওপর ভিত্তি করে স্থায়ী নিয়োগ দেয়া হয়।এসব শিক্ষক সর্বদা একাডেমিক পড়াশোনা ও স্ব স্ব মৌলিক ধরনের গবেষণায় নিজেদের দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত রাখেন।তাই অন্য শিক্ষকদের থেকে নিজেকে এগিয়ে রাখতে তারা সর্বদাই চেষ্টা চালিয়ে যান।শিক্ষকরা শ্রেণি কক্ষে ক্লাস নেওয়ার পূর্বে নির্দিষ্ট টপিকের ওপর যথেষ্ট পড়াশোনা ও চর্চা করে যান যেন শিক্ষার্থীদের আরও সহজ উপায়ে পর্যাপ্ত তথ্য দিয়ে পড়াতে পারেন।এসকল দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়াশোনার পরিবেশ তাই অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মনোরম যার ফলে নির্বিঘ্নে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারেন।কেননা,সেখানে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলোর অনুপ্রবেশের সুযোগই কম থাকে।এতক্ষণে নিশ্চয় বুজে গেছেন যে,আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব পাশ্চাত্য, ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোর উল্টোচিত্র বিদ্যমান।
সাধারণত দেশের দুর্নীতি পরিস্থিতি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় রাজনীতি ও প্রশাসনেই দুর্নীতির চর্চা বেশি।তবে বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনগুলো ও দুর্নীতির ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।স্কুল কলেজ মাদ্রাসা হতে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সর্বত্র দুর্নীতির আখড়া।এসব প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বড় বড় প্রকল্পের সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, নিয়োগে অনিয়ম ও উৎকোচ গ্রহণ,টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজীর মত ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।শিক্ষার্থীদের নিকট হতে বিভিন্ন খাত দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা এবং তা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করার মত অভিযোগও পাওয়া যায় আজকাল।এসব অপকর্মের প্রক্রিয়া থামাতে না পারলে শিক্ষাঙ্গন হবে আরও কলুষিত এবং সঠিক শিক্ষার পরিবেশ হারিয়ে যাবে।সেই সাথে অনৈতিকতার বীজ রোপিত হবে যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থী ও পরবর্তী প্রজন্মের ওপর।তাই
শিক্ষাঙ্গন থেকে দুর্নীতিকে সমূলে উপড়ে ফেলতে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি তানাহলে জাতির ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত ও উৎকন্ঠাযুক্ত।
তথ্য সূত্রঃইন্টারনেট
মোঃফরিদ হাসান

Comments
Post a Comment